কীভাবে সন্তানের (৫-৮ বছর বয়সী) সাথে শরীর ও শরীরের গোপনীয়তার বিষয়ে কথা বলবেন?
প্রাইমারী স্কুল পড়ুয়া অর্থাৎ ৫-৮ বছর বয়সী এই শিশুদেরকে তাদের যে কোন প্রশ্নের সঠিক এবং বয়সের উপযোগী উত্তর দেয়া প্রয়োজন। আজ আপনি আপনার সন্তানকে কতটুকু সঠিক ইনফরমেশন দিচ্ছেন, তার উপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতে সে অন্যদের সাথে কতটুকু সুস্থ্য ও সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সমর্থ হবে। শিশুদের মনে আপনার প্রতি আস্থা গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের বোঝাতে হবে যে তারা আপনার কাছে যে কোন বিষয়ে সাহায্য চাইতে পারে এবং তার জন্যে তারা আপনার কাছ থেকে কোন শাস্তি বা তিরস্কার সম্মুখীন হবে না। এতে করে ভবিষ্যতে আরো গুরুতর বিষয় গুলো নিয়ে তারা আপনার সঙ্গে সহজেই কথা বলতে পারবে। জটিল মনে হচ্ছে? যতটা জটিল ভাবছেন আসলে ততোটা জটিল নয়। কথোপকথন যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত রাখার চেষ্টা করুন এবং দৈনন্দিন জীবনের কোন কোন মুহূর্তগুলোকে সন্তানের জন্য শিক্ষণীয় করে তোলা যায় সেই দিকে লক্ষ্য রাখুন।
প্রাইমারি স্কুল/ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শরীর সম্পর্কে কী কী শিখানো উচিৎ ?
শিশুরা নিজেদের এবং অন্যের শরীরের ব্যাপারে অনেক বেশি কৌতূহলী হয়ে থাকে। তাই শরীর সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিলে শিশুরা নিজেদের সাথে সাথে অন্যদেরকেও বুঝতে, ভিন্নতাকে গ্রহণ করতে ও সম্মান করতে শিখে। যে বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে-
১) এই বয়সী শিশুদের দেহ সম্পর্কে অতিরিক্ত কৌতুহলী হওয়া খুবই স্বাভাবিক। দেহের বিভিন্ন অংশের নাম ও কাজ জানার মতো বয়স তাদের হয়েছে। সন্তান স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তাকে মানানসই পোষাক, কিভাবে পরিচ্ছন্ন ও সুস্থ থাকতে হয় এবং কিভাবে নিজের চেয়ে ভিন্ন (বিপরীত লিঙ্গের) কাউকে শ্রদ্ধা করতে হয় এগুলো সম্পর্কে শিখানো প্রয়োজন। শিশুরা যেন বয়ঃসন্ধিকালে নিজেদের দেহের পরিবর্তন দেখে ঘাবড়ে না যায় বা ভয় না পায় তার জন্যে বয়ঃসন্ধিতে পৌছানোর আগেই তাদের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে এবং তাদের অবগত করতে হবে ভবিষ্যতে শরীরে কী কী পরিবর্তন আসতে পারে সে বিষয়ে।
২) শরীরের রক্ষণাবেক্ষণ প্রসঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত মূল্যবোধ গুলো নিয়ে ভাবুন, একই মূল্যবোধ আপনার সন্তানের মাঝেও বিকশিত করার আগে অন্ততো একবার সেগুলো যাচাই করুন। শিশুর মানবাধিকার খর্ব হয়, এমন কিছু আরোপ করা থেকে বিরত থাকুন।
৩) নগ্নতা এবং শরীরের গোপনীয়তা (প্রাইভেসি) সম্পর্কে আপনার বাড়িতে কি কি নিয়মকানুন রয়েছে? স্বাস্থ্যবিধি বলতে আপনি কী বোঝেন? নিজের দেহ সম্পর্কে কেমন ধারণা ও আত্মবিশ্বাস আপনি আপনার সন্তানের মাঝে গড়ে তুলতে চান? এমন প্রশ্নগুলোর জবাব খোঁজা ও আপনার স্বামী/স্ত্রীর সঙ্গে একই মত পোষণ করা আপনাকে ভবিষ্যতের জন্যে আরো প্রস্তুত করে তুলবে।
৪) সন্তানের সঙ্গে কথোপকথন শুরু করা, তার প্রশ্নের উত্তর দেয়া ও আদর্শ আচরণ করা- এই তিনটি কাজের জন্যে প্রস্তুত থাকুন। অধিকাংশ শিশুরই দেহ সম্পর্কে কৌতুহল থাকে, কিন্তু কোন কোন শিশু একটু লাজুক প্রকৃতির হয় বা তারা বুঝে উঠতে পারেনা যে এই বিষয়ে প্রশ্ন করাটা উচিৎ কি না! এই কারণেই আপনার উচিৎ নিজে থেকে কথোপকথন টা শুরু করা। এখানে মূখ্য বিষয়টি হলো শিক্ষণীয় মুহূর্তগুলো নির্বাচন করা, যেমন আপনার সন্তানের প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিন, তার করা দেহের অংশ সম্পর্কিত কোন প্রশ্ন, কার্টুন , সিনেমা বা নাটকের কোন ক্যারেক্টার নিয়ে কথা বলতে পারেন। সরাসরি না বলে এভাবে বললে সে স্বচ্ছন্দ্যবোধ করবে।
শিশুর সঙ্গে দেহ সম্পর্কে কিভাবে কথা বলবেন?
শিশুরা দেহ বা যৌনতা সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে তাদের আশেপাশে থাকা প্রাপ্তবয়স্করা কেমন আচরণ করছে সেই বিষয়টি খুব লক্ষ্য করে। যদি কোন একটি নির্দিষ্ট শব্দ উচ্চারণ করার জন্য শিশুরা নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া পায় ( যদিও বা সে ওই শব্দটির অর্থ জানে না), অথবা যৌনতা সম্পর্কে করা কোন প্রশ্নের উত্তর যদি প্রাপ্তবয়স্কদের কাছ থেকে তারা না পায়, তাহলে তাদের মনে ধারণা জন্মাবে যে এই বিষয় নিয়ে কথা বলা উচিৎ নয়, বিশেষ করে আপনার বা আপনার বিশ্বস্ত অন্যান্য প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে। তখন তারা হয়তো তাদের বন্ধুদের কাছে প্রশ্নগুলো করবে, কিন্তু তার বন্ধুরা আপনার মতো করে গুছিয়ে প্রশ্ন গুলোর উত্তর দিতে পারবে না। অথবা তারা নিজেরাও সঠিকটা না জানতে পারে। তাই শিশুরা যেন সঠিক তথ্যগুলো পায় তা নিশ্চিত করতে, তাদেরকে বোঝান যে তারা এই সম্পর্কিত যেকোন প্রশ্নই আপনাকে করতে পারে এবং তার জন্যে তাদেরকে আপনি কোনরকম রাগ দেখাবেন না।
যৌনাঙ্গ সহ দেহের অন্যান্য অঙ্গ গুলোর নাম ও কাজ সম্পর্কে জানা শিশুদের জন্য খুবই উপকারী। শিশুদেরকে যৌনাঙ্গ গুলোর সাংকেতিক নাম (গোপনাঙ্গ, বা মজার কিছু যেমন পাখি, টুনটুনি ইত্যাদি) না শিখিয়ে আসল নাম , যেমন যোনিমুখ বা যোনি (ভ্যাজাইনা) শিখানো অত্যন্ত জরুরি। এতে করে শিশুরা বুঝতে পারবে যে অন্যান্য অঙ্গের মতো এটিও স্বাভাবিক একটি অঙ্গ। আপনি যদি শঙ্কিত হন যে দেহের সব গুলো অঙ্গের সঠিক নাম আপনার মনে নেই তবে আপনি নিজেই প্রথমে শারীরের গঠনতন্ত্র সম্পর্কে কিছুটা পড়াশোনা করে নিন।
সব কিছু আপনাকেই শিখিয়ে দিতে হবে এমন না। সন্তানকে বয়স উপযোগী বই কিনে দিন যেন তারা নিজ
থেকেও শিখতে পারে। শিশুকে বুঝিয়ে বলুন যে সে যেকোন প্রশ্ন নিয়ে আপনার কাছে আসতে পারে।
কেন কিছু মানুষের যোনি থাকে এবং অন্যদের পিনাস (পুরুষাঙ্গ) থাকে? কেন বাবা মায়ের মত লোম তাদের দেহে নেই? কখন বা কেনো তাদের স্তন বা পিনাস বড় হবে শিশুদের এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত থাকুন।
সাধারণত প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার পর শিশুদের বয়ঃসন্ধি ঘটে, কিন্তু আগে থেকেই তাদেরকে এই বিষয় গুলো শিখানো উচিৎ যেন নিজের দেহের পরিবর্তন দেখে তারা ঘাবড়ে না যায় বা ভয় না পায়।প্রাথমিক বিদ্যালয় শিশুদেরকে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস ও আচরণ শিখানোর জন্যেও সঠিক একটি সময়। কেন পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, দৈহিক পরিশ্রম এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা (যেমন ,দাঁত ব্রাশ করা এবং গোসল করা ) গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে তাদের সাথে কথা বলুন। এই ক্ষেত্রে আপনি বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে পারেন, যেমন শিশুদের নিয়ে একসঙ্গে দাঁত ব্রাশ করা বা রান্না করার সময় তাদের সাহায্য করতে বলা। তবে যাই হোক না কেন, স্বাস্থ্যকর এবং পরিষ্কার থাকার বিষয়ে আপনার প্রত্যাশা এবং আপনার প্রণীত নিয়মের মাঝে সামঞ্জস্য রাখুন যাতে তারা নিজে নিজে নিজের শরীরের যত্ন নিতে শিখে।
কীভাবে সন্তানের সাথে শরীরের গোপনীয়তা সম্পর্কে কথা বলবেন?
সাধারণত নগ্নতা এবং গোপনীয়তার বিষয়টি নিয়ে এক এক পরিবারের এক এক রকম মানসিকতা কাজ করে। আপনার বাচ্চাকে শিখাতে হবে যে তার অপরকে সম্মান করা প্রয়োজন, তাই অতিথিরা যখন বেড়াতে আসে তখন জামাকাপড় পরতে হবে। শিশুদের বোঝাবেন যে তারা যদি কোনও বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যায় তবে তাদের সেই বাড়ির নিয়ম শৃঙ্খলাকে সম্মান করতে হবে। আপনি যখন আপনার বাচ্চাকে পোশাক পরতে বলছেন তখন এমন ভাবে বলবেন না যেন সে নিজের শরীর নিয়ে লজ্জিত অনুভব করে। এর পরিবর্তে, তাকে বোঝান যে এটি আসলে নিয়মের মধ্যে পড়ে। আপনি এমন কিছু বলতে পারেন,
"তোমার কাজিনরা বেড়াতে আসছে। বাইরের কেউ যখন বাসায় আসবে তখন আমাদের পোশাক পরতে হবে।"
আপনার শিশু যেন জানে যে তার দেহের উপর শুধু তার অধিকার, অন্য কারও নয়- সেই বিষয়টি নিশ্চিত করুন। কারো চাপে পরে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার দেহ প্রদর্শন বা দেহে স্পর্শ করতে দেয়া কখনই উচিৎ নয়। কেবলমাত্র বাবা- মা ও চিকিৎসক (বাবা\মায়ের উপস্থিতিতে) তাকে পোশাক খুলতে বলতে বা তার গায়ে স্পর্শ করতে পারে।
কীভাবে সন্তানের শারীরিক গঠন সম্পর্কে ধারণা গড়ে তুলবেন?
সাধারণত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের শরীর কেমন দেখাচ্ছে- সেই সম্পর্কে কম খুঁতখুঁতে হয়। তবুও সকল বয়সের মানুষই ই নাটক, সিনেমা বা বিজ্ঞাপন দেখে দেহের আদর্শ গড়ন সম্পর্কে ধারণা নিয়ে থাকে। তারা কেন লম্বা নয়, চোখের রঙ কালোর পরিবর্তে কেন বাদামি বা তাদের সহপাঠী কেন হুইলচেয়ার ব্যবহার করে তা নিয়ে শিশুদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। আপনার সন্তানের মুখে এমন কথাও শুনতে পারেন যে, সে অন্য একজনের চেহারা পছন্দ করে না , অথবা সে নিজের চেহারায় কোন পরিবর্তন আনতেও ইচ্ছা পোষণ করতে পারে।
আপনি আপনার বাচ্চাকে বুঝতে সাহায্য করতে পারেন যে সবার দেহ আলাদা, এবং অসাধারণ বা নিখুঁত বলে কোনও জিনিস নেই। এটি তাদের শরীর সম্পর্কে পজিটিভ মানসিকতা গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। নিম্নোক্ত উপায়ে আপনি শিশুদের মাঝে দেহের গঠন সম্পর্কে স্বাস্থ্যকর মানসিকতা গড়ে তুলতে
পারেনঃ
১) শিশুর চেহারা অন্য কারও সাথে তুলনা করবেন না - এমনকি তার প্রশংসা করার সময়ও নয়।
২) নিজের চেহারা সম্পর্কে সন্তানের সামনে অভিযোগ করবেন না।
৩) কোন পোষাকে শিশুকে সুন্দর দেখালে তার প্রশংসা করা যেতে পারে। কিন্তু প্রশংসাটি যেন শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্যের ব্যপারেই না হয়।
৪) বাহ্যিক সৌন্দর্যের পরিবর্তে সুস্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দিন।
৫) শিশুদেরকে বোঝান যে মডেল বা সেলিব্রেটিদের (এমনকি কার্টুন ক্যারেক্টার) ছবি ও ভিডিওগুলো অতিরঞ্জিত এবং অবাস্তব।
৬) তাদের নিজস্ব জাতিগত /বর্ণগত পরিচয়, লিঙ্গ পরিচয় ও তাদের শরীরের সক্ষমতা ইত্যাদি নিয়ে গর্বিত হতে উৎসাহিত করুন। তবে তা যেনো অন্যদের ছোট করার উদ্দেশ্যে না হয়।
Comments
Post a Comment